মায়ের পুজো হয় কালীর ধ্যানে, ভোগে মাছ নিবেদন আবশ্যিক, প্রাচীন এক কালী মন্দিরের মাহাত্ম্যকথা

Anandamayi Tala Kali Mandir Krishnanagar
বহুদিন আগের কথা। বর্তমানে কৃষ্ণনগর হিসেবে আমরা যে এলাকাকে চিনি, তার পূর্বনাম ছিল রেউই। নদিয়ার বিখ্যাত রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের পূর্বতন পুরুষ ছিলেন রাজা রাঘবের পুত্র মহারাজ রুদ্র। রাজা রুদ্র ছিলেন একনিষ্ঠ কৃষ্ণভক্ত। ভক্তিপরবশত তিনিই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নামানুসারে রেউইয়ের নাম পরিবর্তন করে রাখেন কৃষ্ণনগর।
অষ্টাদশ শতকে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্বকালে নদিয়া জেলার পুরাকীর্তির ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় রচিত হয়। তিনি ছিলেন নতুনের সমর্থক। শুধু তাই নয়; জ্ঞান, বিদ্যা ও শিল্পচর্চার পৃষ্ঠপোষক কৃষ্ণচন্দ্রের আমলেই কৃষ্ণনগর সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। এই সময়কালে নদিয়াতে নির্মিত হয় বহু মন্দির। লক্ষ্য করার বিষয়, মন্দিরগুলির গঠনশৈলী ছিল গতানুগতাবর্জিত। অসাধারণ বৈশিষ্ট্যযুক্ত এই গঠনরীতিকে ‘কৃষ্ণচন্দ্রীয় মন্দির স্থাপত্যরীতি’ বলে চিহ্নিত করা চলে নিঃসন্দেহে। তবে এই স্থাপত্যরীতি নদিয়া ছাড়া বাংলার অন্য কোথাও মন্দির নির্মাতারা গ্রহণ করেননি, এমনকি রাজার বংশধররাও। এর কারণগুলির মধ্যে ধরা হয় যুগের পরিবর্তন, অর্থের অভাব, কারিগরি দক্ষতার হ্রাস ইত্যাদি। যাইহোক, অষ্টাদশ শতকে কৃষ্ণনগর তথা নদিয়ার সংস্কৃতি ছিল যেন সারা বাংলার সংস্কৃতি।
কৃষ্ণনগর স্টেশন থেকে রিকশায় আনন্দময়ী রোড ধরে মিনিট-কুড়ি গেলে রাস্তার পাশেই আনন্দময়ী কালীমাতার মন্দির। সামান্য দূরেই রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের বাড়ি। দেবীর নামেই মন্দির সংলগ্ন এলাকার নাম আনন্দময়ীতলা। সুদৃশ্য আলগোছ বা একরত্ন মন্দিরটির প্রতিষ্ঠাতা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রপৌত্র গিরিশচন্দ্র রায় বাহাদুর। মন্দিরে রাজা গিরিশচন্দ্র রায়ের নাম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে খোদাই করা আছে। ছবিও আছে তাঁর। সেবাইত হিসেবে নামোল্লেখ আছে শ্রী সৌমীশচন্দ্র রায়ের। শোনা যায় গিরিশচন্দ্র রায় তন্ত্রসাধকও ছিলেন। মন্দিরটি স্থাপিত হয়েছিল ১৮০৪ সালে। গিরিশচন্দ্র রাজা হওয়ার ২ বছর পর মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি কৃষ্ণচন্দ্রের মন্দির নির্মাণরীতি অনুসরণ করেননি। মন্দিরের ছাদ কাঠের কড়ি বরগায় তৈরি। গর্ভগৃহের সামনেই পাঁচ খিলানযুক্ত বারান্দা। সমতল ছাদ দালানের উপর চারচালা শিখরযুক্ত মন্দিরে আছে সামান্য পঙ্খের অলংকরণ। দক্ষিণমুখী আনন্দময়ী মন্দিরটি সাধারণ দোতলা বাড়ির থেকে সামান্য উঁচু। মন্দিরের চূড়ায় রয়েছে তিনটি ধাতুনির্মিত ফলক। মন্দিরটির শিল্পশৈলী আদিম ও প্রাচীন।
Anandamayi Tala Kali Mandir Krishnanagar
চারদিক প্রাচীরে ঘেরা। প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকলেই মন্দিরঅঙ্গন। এর ডানপাশে মা অন্নপূর্ণা ও গৌরাঙ্গদেবের মন্দির। অঙ্গনের বাঁদিকে দক্ষিণ-পশ্চিমে দোতলায় আনন্দময় শিব মন্দির। ঠিক এর নিচের তলায় সিংহাসনে হাত পা মেলে নাড়ু নিয়ে বসে আছেন গোপাল বিগ্রহ।
Anandamayi Tala Kali Mandir Krishnanagar
এবার গর্ভমন্দিরের কথা। পঞ্চমুন্ডের আসনের উপর পাথরের বেদিতে হাঁটু মুড়ে যোগাসনে শুয়ে আছেন মহাদেব। শ্বেতপাথর নির্মিত বিগ্রহ। পূর্ব-পশ্চিমে শায়িত। মহাদেবের বুকের উপরে পদ্মাসনে বসে আছেন দেবী আনন্দময়ী। কষ্টিপাথরে নির্মিত নয়নাভিরাম বিগ্রহ উচ্চতায় সাড়ে ৩ ফুটের কাছাকাছি, দেবী চতুর্ভুজা। সোজাসুজি তাকালে বেদির ডানপাশে আছে ছোট্ট একটি কালীমূর্তি। এছাড়াও মন্দির অলংকৃত দেবী শীতলা ও অন্যান্য দেবদেবীর বিগ্রহে।
Anandamayi Tala Kali Mandir Krishnanagar
মন্দিরের পাদপীঠে নিবন্ধ প্রস্তরলিপিতে উৎকীর্ণ আছে –
‘বেদাঙ্গেক্ষণগোত্রকৈরবকুলাধিপে শকে শ্রীযুতে
কৈলাসপ্রতিরূপকৃষ্ণনগরে শ্রীমদগিরীশোৎসবে।
নাম্নানন্দময়ী শুভেহহনি মহামায়া মহাকালভৃৎ
রাজ্ঞা শ্রীলগিরীশচন্দ্র ধরণীপালেণ সংস্থাপিতা॥’
অর্থাৎ কৈলাসতুল্য কৃষ্ণনগরে শ্রীমান গিরীশের শুভ উৎসব দিনে ১৭২৬শকাব্দে মহাকালধারিণী আনন্দময়ী নামে দেবী মহামায়াকে রাজা গিরিশচন্দ্র স্থাপন করেন। এখানে ‘বেদাঙ্গ’=৬, ‘ইক্ষণ'(চক্ষু)=২, ‘গোত্র'(পর্বত)=৭, ‘কৈরবকুলাধিপ'(চন্দ্র)=১ ধরে ‘অঙ্কস্য বামাগতি’ নিয়মে প্রতিষ্ঠাকাল ১৭২৬শকাব্দ।
লোকশ্রুতি আছে, দেবী আনন্দময়ীর ধ্যানরতা মূর্তিতে স্বপ্নে দর্শন দিয়ে ওই মূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে বলেছিলেন রাজা গিরিশচন্দ্রকে। দেবী মূর্তিটি আজ যেখানে প্রতিষ্ঠিত সেখানেই নাকি পাওয়া গিয়েছিল প্রকাণ্ড একটি কষ্টিপাথর। যে পাথরে নির্মিত হয়েছে মহারাজের স্বপ্নে দেখা বিগ্রহ। শিলাখন্ড থেকে মূর্তি নির্মাণ করা হয় দুটি। একটি আনন্দময়ী কালী, আর একটি ভবতারিণী কালী।
ভবতারিণী কালী নবদ্বীপ ধামে পোড়ামাতলায় নিত্যপুজো পেয়ে চলেছেন আজও। আনন্দময়ীর পুজো হয় কালীর ধ্যানে। আনন্দময়ী এবং ভবতারিণী দুটি ক্ষেত্রেই দেবীর পুজোতে মাছ ভোগ দিতে হয়। আগে বলিপ্রথা চালু ছিল। তবে বেশ কিছুদিন হল তা বন্ধ আছে।
Anandamayi Tala Kali Mandir Krishnanagar
আনন্দময়ী মন্দিরের পুরোহিত চন্ডীচরণ ভট্টাচার্য জানালেন, তাঁরা বংশপরম্পরায় পুজো করে আসছেন এই মন্দিরে। তিনি এও জানান, মন্দিরের বর্তমান সেবাইত সৌমীশচন্দ্র রায়। মন্দির প্রতিষ্ঠা হয় ১৮০৪ সালে। যদিও মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতার নাম নিয়ে দ্বিমত আছে। কেউ কেউ বলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র, আবার কেউ কেউ বলেন রাজা গিরিশচন্দ্র মন্দিরটির প্রতিষ্ঠাতা। তবে যিনিই প্রতিষ্ঠা করুন না কেন, তিনি যে স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সে বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। নিত্য পুজো ও নিত্যভোগ হয়ে আসছে এখনও। আগে মা আনন্দময়ীর গায়ে কাপড় ছিল না। পরবর্তীকালে ভক্তদের অনুরোধে তাঁদের দেওয়া কাপড় মাকে পরানো হয়ে থাকে। মন্দির খোলে সকাল ৬টায়, বেলা ২টোয় বন্ধ হয়। আবার বিকেল ৩.৩০-৪টেয় খুলে রাত ৯টায় বন্ধ হয় মন্দির। ভক্তসমাগম বেশি হয় কালীপুজো, ১লা বৈশাখ ও বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে।
Anandamayi Tala Kali Mandir Krishnanagar
মায়ের পুজো হয় কালীর ধ্যানে, ভোগে মাছ নিবেদন আবশ্যিক, প্রাচীন এক কালী মন্দিরের মাহাত্ম্যকথা মায়ের পুজো হয় কালীর ধ্যানে, ভোগে মাছ নিবেদন আবশ্যিক, প্রাচীন এক কালী মন্দিরের মাহাত্ম্যকথা Reviewed by Admin Amit on July 05, 2018 Rating: 5

No comments:

Powered by Blogger.