সুন্দরবন সমুদ্র উপকূলবর্তী নোনা পরিবেশের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনভূমি। পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হওয়ার বিষয়টি উদ্বেগজনক। প্রকৃতি ও মানুষের নিষ্ঠুর আচরণে আমাদের গর্বের সুন্দরবন ক্রমেই শ্রীহীন হয়ে পড়ছে। পাশাপাশি বনের অনেক প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতি বিলুপ্ত হওয়া আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বছরের পর বছর ধরে অপরিকল্পিতভাবে বনজসম্পদ আহরণের ফলেই যে এমন ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে এগিয়ে চলেছে বিশ্বখ্যাত সুন্দরবন। এ ধ্বংসলীলা বন্ধে অবিলম্বে পদক্ষেপ নেয়া উচিত। ১৯৯৭ সালে সুন্দরবন ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি পায়। গাছ-পালা, পশু-পাখি, সরীসৃপ, মৎস্যসম্পদের প্রাচুর্য্যতা ও নদ-নদীতে বিস্তৃত সুন্দরবন শুধু জীববৈচিত্র্যের এক উৎস ভূমি। এ অঞ্চলের প্রায় ১০ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকার উৎস হিসেবে অবদান রাখছে সুন্দরবন। বিশ্বখ্যাত এ বন সুরক্ষার বিষয়টি উপেক্ষা করে দীর্ঘদিন ধরে অবাধে বৃক্ষ নিধন, নির্বিচারে মৎস্য সম্পদ আহরণ, পশুহত্যা ও পাচার করার কারণে হুমকির মুখে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য।
সুরক্ষায় কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ না থাকায় ইতোমধ্যে সুন্দরবন থেকে বিলুপ্ত হয়েছে দু’প্রজাতির উভচর প্রাণী, ১৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৫ প্রজাতির পাখি ও ৫ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী।
১৯০৩ সালে প্রকাশিত প্রেইন এর হিসাব মতে সর্বমোট ২৪৫টি শ্রেণি এবং ৩৩৪টি প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। সুন্দরবনের জলাভূমিতে প্রায় ১২০ প্রজাতির মাছ আছে, পাখি আছে ২৭০ প্রজাতির; স্তন্যপায়ী পশু আছে ৪২ প্রজাতির; সরীসৃপ আছে প্রায় ৩৫ প্রজাতির, আর উভচর প্রাণী আছে প্রায় ৮ প্রজাতির। সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থান মৌলিক প্রকৃতির এবং যা বন্য প্রাণীর বিশাল আবাসস্থল। ২০০৪ সালের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, সুন্দরবনের বিশ্বখ্যাত রয়েলবেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা প্রায় ৪৪০টি (এর মধ্যে পুরুষ বাঘ ১২১টি, বাঘিনী ২৯৮টি এবং বাঘ শাবকের সংখ্যা ছিল ২১টি), যা সারা বিশ্বে বাঘের একক অবস্থান হিসেবে সর্ববৃহৎ।
গত ১০০ বছরে সুন্দরবন থেকে ইতোমধ্যে ২৯ প্রকার প্রাণী বিলুপ্ত হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে বাঘরোল, চিতা বিড়াল, বার্কিং হরিণ, বন্য মহিষ, দু’প্রজাতির গ-ার, ভোঁদড়, শুশুক (ডলফিন), সর্দার গুইসাপ, গুইসাপ, কাঠা, চিরুনি, কচ্ছপ, ময়াল, দৈত্য বক, সাদা পেচা, সমুদ্র ঈগল, মেছো বাঘ, সাগর কাঁকড়া, সাগর কুসুম, সাগর শসা, শকুন, পেঁচা, রক্তবর্ণ মেছো শামুক, মিঠে পানির কুমির, নীল গাই, নেকড়ে, সোয়াম্প ডিয়ার, সরসপাখি। এসব প্রাণী বিলুপ্তির পেছনে মানুষের ভূমিকাই প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন এবং চোরাকারবারি ও শিকারিদের কারণে হুমকির মুখে পড়েছে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য।
বিশেষ করে সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা হ্রাস এর পেছনে মূল কারণ এই জলবায়ু এবং চোরাকারবারি। ২০১২ এর বাঘশুমারি অনুযায়ী বাঘের সংখ্যা ২৫০ এর নিচে। অনুমেয়-২৪৬।
প্রাণিবিজ্ঞানীদের মতে, দেশে যে পরিমাণ বাঘই থাকুক দ্রুত এর সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। এর কারণ হিসেবে তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জলবায়ু পরিবর্তনকেই দায়ী করেন। তিনি বলেন, এর প্রভাবে একদিকে বন ধ্বংস হচ্ছে, অন্যদিকে ধ্বংস হওয়া এলাকায় নতুন বসতি গড়ে উঠছে। এতে বনের ওপর নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। আর এ কারণে বাঘের স্বাভাবিক চলাচলের স্থান ক্রমেই সঙ্কুচিত হচ্ছে।
গত এক দশকে সুন্দরবন এলাকায় লবণাক্ততা বেড়েছে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ। এভাবে লবণাক্ততা বাড়তে থাকায় সুন্দরবনের বৃক্ষরাজি নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। সুন্দরবনের অন্যতম উদ্ভিদ এবং যে গাছের নামে এ বনের নামকরণ হয়েছে, সেই সুন্দরী গাছও ব্যাপকভাবে আগামরা সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, জলবায়ু পরিবর্তন ও লবণাক্ততার প্রভাবে আগামী দুই দশকের মধ্যে সুন্দরবন থেকে সুন্দরী গাছ বিলীন হয়ে যেতে পারে। প্রকৃতির অনন্য উপহার অসংখ্য সম্পদরাজিতে ঐশ্বর্যমণ্ডিত সুন্দরবন কিছু মানুষের দুর্বৃত্তপনায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। নিমেষে ধ্বংসের মুখে পতিত হচ্ছে সুন্দরবনের ঐশ্বর্য, প্রাণবৈচিত্র্য। সুন্দরবন রক্ষায় একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। সেজন্য সবাইকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সুন্দরবনের প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে।
হারিয়ে যাচ্ছে জীববৈচিত্র্য
Reviewed by Admin Amit
on
May 15, 2018
Rating:
No comments: